তনঠন

No comments

 

অদৃশ্য টান
কাঙ্ক্ষিতা সাইকি
নীরা এক দৃষ্টিতে আটার গোলাগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট! আর কিছুক্ষণের মাঝে বেরুতে না পারলে অফিসের বাসটা মিস হয়ে যাবে। আর আজ অফিসে দেরি হলে তিন দিনের দেরীর হিসেবে এক দিনের বেতন কাটা যাবে।
এটা শুধু আজকের নয়। নিত্যদিনের ঘটনা। প্রতিটা সকাল তার অরণ্যের সাথে ঝগড়া দিয়ে শুরু হয়। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যপার হোল ঝগড়ার কারণ খুবই তুচ্ছ! একটি রুটিমেকার!! নীরার বিয়ের পরদিনই যেটা রান্নাঘরে প্রথম পায়ের ছাপ ফেলেই খুঁজে পায়। বহুদিনের পুরনো এবং জং ধরা। কিছু কিছু জায়গায় রঙ উঠে বাজে অবস্থা। শুধু তাই নয়! ব্যবহার অযোগ্য। কখনো কখনো কারেন্টের লাইন ঠিক ভাবে পায় না। নীরা ঘর গোছাতে গোছাতে বলল
-এটা অনেক পুরনো হয়ে গিয়েছে। ফেলে দি? কাল না হয় আরেকটা কিনে আনব! রুটিমেকারের দাম তো বেশি না
এই কথা বলে যেই না অরণ্যের দিকে তাকালো সাথে সাথে চমকে গেলো। অরণ্য তার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছে! প্রচণ্ড জোরে সে উত্তর দিল
--“না!!” এটা তুমি কিছুতেই ফেলবে না। এটা যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। নতুন রুটিমেকার ও কিনে আনবে না
নীরা একই সাথে অবাক ও বিরক্ত হোল। ঘর গোছাতে গোছাতে কত অপ্রয়োজনীয় জিনিসই তো সে ফেলে দিল! কই? একবারও অরণ্য কিছু বলল না? এই বাজে রুটিমেকারটায় কি এমন আছে যার জন্য সে এভাবে রেগে গেলো!
যাক। সেদিনের মত এ ঘটনা মিটে গেলেও শেষ হোল না। প্রতিদিন এই রুটিমেকারের পেছনে প্রয়োজনীয় সময় নষ্ট করে সকালে বেরুতে দেরী হয়ে যায়। কিন্তু আর না! আজ একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে। হয় এই রুটিমেকার থাকবে বাসায় আর নতুবা সে!
নীরা ক্ষিপ্রগতিতে ওদের ঘরের দিকে যাচ্ছে। পর্দাটা সরাতেই তার পা আটকে গেলো! ঘরে অরণ্য নেই! পুরো ঘর মোমের আলোয় সাজানো। টি টেবিলে ছোট্ট একটা কেক। তাতে লেখা “মনে পড়ে!!”
পাশে একটা রঙিন চিরকুট। নীরা খুব অস্বস্তি নিয়ে চিরকুটটা হাতে নিল। কিছুটা ভয় আর কিছুটা সংকোচে পড়তে শুরু করলো।
নীরা,
আমি জানি তুমি একই সাথে খুব অবাক ও বিরক্ত! আরও বেশি ক্ষুব্ধ ঐ নিষ্পাপ রুটিমেকারটির ওপর। বারবার ঘড়ি দেখছো কখন বেরুবে। কিন্তু এই মুহূর্তে এমনিতেই দেরী হয়ে গিয়েছে এবং আরও একটু বেশি দেরী হলে বোধয় খুব একটা কম বেশি হবে না। তাই ঠান্ডা মাথায় কথাগুলো পড়বে এই অনুরোধ রাখি।
নীরা! তুমি আমার চোখে দেখা অসম্ভব বুদ্ধিমতী একটা মেয়ে! কিন্তু আমি প্রতিদিনই খুব ধাক্কা খাই এই দেখে যে তুমি রুটিমেকারটি চিনতে পারছো না! এই রুটিমেকারটি সেই রুটিমেকার যেটা তুমি বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছিলে। আর আমি তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলাম এটা নিতে এক ভর সন্ধ্যায়। যেহেতু আগের দিন আসার কথা বলে আসিনি এবং পরের দিন ভর দুপুরে তোমার কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে আসার কথা বলেছিলাম তাই ভেবেছিলাম তুমি স্বাভাবিকভাবেই আমার ওপর বিরক্ত। দরজাটা তুমি বিরক্তি নিয়েই খুলেছিলে। আমি ভেতরে ঢুকলাম; কিন্তু খুব অবাক হয়ে দেখলাম তুমি কফি বানিয়েছো আমার জন্য! অথচ তুমি খুব বিরক্ত। হঠাত আমার মনে হোল বিরক্তিটা শুধু আমার ওপর হলে কফিটা তুমি বানিয়ে রাখতে না। বুঝতে পারছিলাম না বিরক্তির উৎস টা আসলে কি! কফিটা মুখে দিয়ে বুঝলাম এতে চিনি নেই। আমি কফিতে চিনি খাই না এটা তোমার জানার কথা না! কফি খেতে আমার কোনও সমস্যাও তাই হোল না! শুধু এই অস্বস্তি টুকু ছাড়া!
রুটিমেকারটা নেবার সময় তুমি বললে “আমি চেক করে রেখেছি। আপনি কি চেক করতে চান?” আমি বললাম লাগবে না। তুমি বললে “তাহলে ওখানে রাখা, নিয়ে নিন”। তুমি ওটা নিজ হাতে তুলে দিলে না পর্যন্ত! তখনই আমার মনে হোল তোমার বিরক্তির কারণ এই রুটিমেকার!! এগুলো হয়ত তুমি সব না জানলেও অনেকটাই জান। যা জাননা তা জানাতেই আমার আজকের এ প্রয়াস।
নীরা, রুটিমেকার টা নিয়ে আমি যখন আমার মেসে ফিরে গেলাম তখন আমি খুব ক্লান্ত। পরদিন সকালে অফিস। তাই ভাবলাম রুটিমেকারটা বের করে রাখি। পরদিন সকালেই তো কাজে লাগবে! প্যাকেটটা খুলতে গিয়ে বুঝলাম এটা বহু আগে প্যাকেট করা! কারণ যে দড়িটা দিয়ে বাঁধা তা পুরোনো হতে হতে এতটা ভঙ্গুর হয়ে গিয়েছে যে ওটার গিট খোলার আগেই তা ছিড়ে যায়। রুটিমেকার টা বের করার পর আমি আরও বড় ধাক্কা খেলাম। কারণ এটা দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো এটা একদিনও ব্যবহৃত হয় নি!! অথচ তুমি বিজ্ঞাপনে লিখেছিলে দুবছরের ব্যবহৃত !! আমি তখন হন্যে হয়ে এটার রিসিট টা খুঁজতে থাকি। রিসিট পেলাম না। কিন্তু পেলাম ছোট একটা ভাঁজ করা কাগজ যা প্যাকেটটির এক কোণায় পড়ে ছিল। খুলে দেখলাম একটা চিঠি সেটা! এবং তা তোমাকেই লেখা। অন্যের চিঠি পড়তে নেই! কিন্তু সে সময়ের কৌতূহল, বিস্ময় এবং দায়িত্ববোধ আমাকে বাধ্য করল চিঠিটা পড়ে শেষ করতে। চিঠিটা আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি এখানে।
নীরা,
আমি জানি রুটিমেকারটি তোমার কোনও কাজে আসবে না। তোমার মা রুটিমেকার ব্যবহার করেন না। আর তুমি রান্না খুব একটা কর না। কিন্তু আমার এ দৈন্যদশায় আমাকে সাহায্য করার ইচ্ছেটাও তোমার প্রবল ছিলো। আবার আমি অপমানিত বোধ করলেও তুমি কষ্ট পাবে। তাই পুরোটা ম্যানেজ করার জন্য আমার বিজ্ঞাপন দেখে তুমি রুটিমেকারটা কিনতে চেয়েছো । কারণ ওটা ওটা বহুদিন ধরে পড়ে ছিল। কেউ নিচ্ছিলো না। আর তাই তুমি বললে
মানুষ বিশ্বাস করছে না ওটা নতুন। কেনার পরদিন ই তুমি বিজ্ঞাপন দিয়েছো! নতুন জিনিস কেউ বিজ্ঞাপন দিয়ে বিক্রি করে না। আমার একটা লাগবে। দোকানে যেতে আলসেমী লাগছে। আমাকে দেবে?
বলেই টাকা দিয়ে বললে কাল নিয়ে এসো।
এমনকি জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলে না কত দাম। টাকাটা তোমার সামনে গুনে নেইনি। কিন্তু আসায় গিয়ে টাকার পরিমাণ দেখে বুঝলাম তোমার ওটা লাগবে না। টাকা দেয়াটাই তোমার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। যাক গে...
নীরা আমি জানি তুমি আমাকে যা দিয়েছো ভালবেসে দিয়েছো । তাই আমি কষ্ট পাইনি। তোমার এই মাতৃরূপ অক্ষয় হোক! আজকের এই ভয়াবহ দিনে এই প্রার্থনাটুকুই করি তোমার জন্য। আর যদি কখনও ভালো দিন আসে এই ভালোবাসা বহুগুণে তোমাকে ফিরিয়ে দেব এই পরম চাওয়া...
ইতি
তোমার রোদ্র
আমি বুঝলাম না আসলে আমার কি করা উচিৎ। তোমাকে চিঠিটার কথা জানানো উচিৎ? কারণ আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম প্যাকেট টা যেভাবে তোমার কাছে এসেছে ঠিক সেভাবেই আমার কাছে এসেছে। একটিবার তুমি খুলে দেখনি। চিঠির নিচের তারিখ থেকে বুঝলাম দুবছর আগের লেখা। তার মানে দুটো বছর এ অবস্থাতেই এটা তোমার কাছে ছিল! যাক গে... Prrbook Upworkmarket postmaster topguru monstarpublic usamarking powerbank cutly Redifiv bookstar link Youtubbook tumblrro Postmind Probook SocialMarking Prrmarsub Hastagcode Wortweb wwwsmbook quora-answer curred-add wordpress-wo classifiedsa Top-Backlinks Aliexpress Twin-M F-s-a-m-f Gabsocialm Temp Mail অনেক চিন্তা করে দেখলাম একথা জানালে তোমার আজ আর কোনও উপকার হয়ত হবে না। শুধু অস্বস্তি টুকুই বাড়বে। তাই চেপে গেলাম। এ কথা আমার আর মনেও থাকলো না।
ঠিক তার দুদিন পরেই তুমি খুব অস্বস্তি নিয়ে আমাকে ফোন দিলে। তোমার ফোন দেখে আমি ভাবলাম চিঠিটি হয়ত তোমারই কোনও ভুলে চলে এসেছে। ওটি ফেরত নিতেই হয়ত এই ফোন। কিন্তু না! আমি সেদিন তোমার কথায় আরও নিশ্চিত হলাম যে এ ব্যপারে তুমি কিছু জাননা। তুমি শুধু এই খোঁজ টুকু নেবার জন্যই ফোন করেছো যে রুটি মেকারটি ঠিক ভাবে কাজ করছে কিনা! কারণ নতুন বলে তুমি আর চেক করে দেখনি। আর বারবার সরিও বললে কফিতে চিনি না দেবার জন্য। তুমি চিনি খাও না। তাই ভুলে একই ভাবে আমার কফিটাও ওভাবে বানিয়েছিলে।
এভাবেই আমাদের যোগাযোগ শুরু হোল একটা রুটিমেকারকে কেন্দ্র করে। বাকি সবই তুমি জান। তোমার সরল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বারবার মনে হয়েছে এই চিঠির কথাটা তোমাকে বলি। বারবার চেষ্টাও করেছি। কিন্তু বিশ্বাস কর! আমি পারিনি। তোমার চোখে চোখ রাখার পর আমার কন্ঠ রোধ হয়ে আসত। আমি পারিনি তোমাকে কিছু জানাতে...
এর মাঝে একদিন তোমার বন্ধু লাবণ্য এর সাথে দেখা হয়েছিলো রাস্তায়। ও আমাকে জোর করে কফি খাওয়াতে নিয়ে গেলো। কফি খেতে খেতে আমি বুঝলাম সে আমাকে এমনি ডেকে আনেনি। কিছু বলতে চায়। সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো আমি সত্যিই তোমাকে চাই কিনা! যদি না চাই তাহলে যেন তোমাকে মুক্তি দি। এ কথা শুনে আমার খুব অপমান বোধ হোল। আমি খুব রেগে গেলাম। তখন সে বলে দিলো তোমার আরও কিছু কথা! তোমার হেরে যাবার গল্প, কোনও বিষণ্ন বিকেলে তোমার হারিয়ে যাবার গল্প। আমি বুঝতে পারলাম সে চিঠিতে যে তোমাকে ভালো দিন এলে ভালবাসা বহুগুণে ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সে বহুগুণে তোমাকে নিঃশ্বেষ করে স্বপ্নের পথে পাড়ি দিয়েছে। লাবণ্য সব শেষে বলল “আমার এই বন্ধুটি এমনিতেই বড় কষ্ট পেয়েছে। তাই আপনাকে এই অনুরোধ টুকু করা।” আমি সেদিন থেকে লাবণ্যকে ভীষণ শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম... ও বলেছিলো এই কথাগুলো যেন তোমাকে কখনো না বলি। আজ আমি লাবণ্যর কাছে ক্ষমা চাইছি। এবং আমি জানি সে ঠিক আমায় ক্ষমা করবে। এ আমার দাবী নয়! এ আমার বিশ্বাস...
এবার তুমি বলত নীরা!! যে রুটিমেকার তোমাকে আমার জীবনে আশীর্বাদ হিসেবে পাঠিয়েছে, যে রুটিমেকারটিকে তুমি অবহেলায় বারবার তাড়িয়ে দিলেও শেষমেশ তোমার রান্নাঘরেই আশ্রয় নিয়েছে তাঁকে কি করে আমি ফেলে দিতে পারি!! থাক না আমাদের সাথে! আমাদের কাছের কেউ হয়ে অদৃশ্য কোনও টানে? চোখ মোছ নীরা! আমি জানি আজ তুমি অফিসে গেলেও একদিনের বেতন কাটা যাবে। তার চেয়ে বরং নিচে নাম। আমি মোড়ের দোকানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। রিকশা ঠিক করা আছে। বহুদিন একসাথে রিকশায় ঘুরি না...

No comments :

Post a Comment